Read more
বলখ দুলালী বনে কেন?
**বলখ রাজ্য ও বলখ দুলালী**
হিজরী প্রথম শতাব্দির শেষের দিকে বনু উমাইয়ার খেলাফতের যুগে চীন সীমান্তে প্রায়ই বিদ্রোহ দেখা দিত। ঐ সময় কেন্দ্রীয় খলীফার অনুমতিক্রমে আবুল হাসান বলখী নামক একজন বীর সেনাপতি খোরাসান হতে চীন সীমান্ত পর্যন্ত এক বিশাল এলাকা শত্রুমুক্ত করে বলখ রাজ্য নামে একটি স্বাধীন মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। যার উত্তরে আজারবায়জান দক্ষিণে কাবুল ও কান্দাহার পূর্বে চীন ও পশ্চিমে খোরসান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। হিমালয় পর্বতের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। ছোট ছোট পাহাড়-পর্বত ও সবুজ অরণ্য ঘেরা দেশটি খুবই মনোরম। আমু দরিয়া নামক একটি খরস্রোতা নদী হিমালয় পর্বত হতে উৎপন্ন হয়ে বলখ সাগরে পতিত হয়েছে । অসংখ্য ঝরণা প্রবাহিত হয়ে কৃষি কাজ ও বাগ –বাগিচাগুলো সতেজ রাখত। বাগানগুলো নানাবিধ ফঃল –ফলাদিতে পরিপূর্ণ ছিল। পাহাড় মূল্যবান পাথর পাওয়া যেত। কোনো কিছুর অভাব ছিল না সে দেশে। সুলতান আবুল হাসান ছিলেন একজন ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ন বাদশা, প্রজাদের সুবিধার্থে নামেমাত্র কর গ্রহণ করতেন। ইসলামী শরীয়তের আইন বলবৎ ছিল সে দেশে। কোনো প্রকার জুলুম অত্যাচার ও পাপ কাজের সুযোগ ছিল না সেখানে। জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ ছিল খুব সুন্দর । বর্তমান এটা আফগানিস্তানের বলখ নামের একটি প্রদেশ হিসাবে বিদ্যমান আছে। আলেম উলামা ও পীর দরবেশদের খুব সমাদর ছিল সেখানে। কারণ হুযুর (সা.) এর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের বংশধরগণ পৃথিবীর দিগ দিগন্তে দীনের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। যার ফলে বাগদাদ ও সমরখন্দ বোখারা তালীম ও তরবিয়তের কেন্দ্র রূপে গড়ে ওঠে। তাড় প্রভাব বলখেও পড়েছিল। সে কারণে বলখ ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র।
বাদশা আবুল হাসানের কোনো পুত্র সন্তানছিলনা। সংসার ছিল অতি সুখের । পরম করুণাময়ের একান্ত অনুগ্রহে তাদের বালাখানায় সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় একটি অপরূপ সুন্দরী কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বাদশা আবুল হাসান তাঁর নাম রাখলেন ’গুলেজান্নাত’ যার অর্থ হল- ‘জান্নাতের ফুল’ সত্যই। শৈশব হতেই শাহজাদী ফুলের মত পবিত্র ও সুন্দর চরিত্রের অধিকারী ছিলেন আর ইবাদত বন্দেগীতে ছিলেন রাবেয়া বুসরীর মত একজন তাপসী। নামায রোযা কুরআন তেলাওয়াত যিকির আযকার ও পর্দা পুশিদা দ্বারা তিনি সে যুগের ।একজন তাপসী কন্যারূপে গড়ে উঠেছিলেন।দাস দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতেন। অবসর সময়ে সহপাঠিদের নিয়ে খেলা করতেন। শৈশব হতেই তিনি ফুলকে খুব ভালোবাসতেন ফুলের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখে বাদশা আবুল হাসান প্রাসাদের অদূরে একটি ফুলবাগিচা তৈরি করলেন। শাহজাদি গুলেজান্নাতের জন্য। তিনি চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতি শুক্রবার বিকেলে সে উদ্যানে পর্দাযুক্ত আট বেহারার পালকিতে চড়ে গমন করতেন। সেখানে কিছুক্ষণ ভ্রমণ করে পুনরায় বাসভবনে ফিরে আসতেন। এভাবে শাহজাদী ক্রমে বড় হতে লাগলেন তিনি লেখা পড়ায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন ফলে কুরআন ও হাদীসে অগাধ জ্ঞান অর্জন করলেন। রাজকার্য পরিচালনার জন্য পিতাকে সাহায্য করতেন। এভাবে তিনি সব গুণে গুণান্বিত ছিলেন। অনেক দেশের রাজপুত্রদের জন্য তার বিবাহের প্রস্তাব আসতে লাগল। কিন্তু তিনি দুনিয়ার জৌলুস মোটেই পছন্দ করতেন না। তিনি মনে মনে ধারণা করেছিলেন যে তিনি চির কুমারী থাকবেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা তা ছিল না, তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র ইবাদত বন্দেগী ও নিজ মহিমা প্রকাশ করে আরো কিছু বান্দা বান্দি সৃষ্টি করার জন্য।
**দরবেশ আদহাম**
দরবেশ আদহাম বাল্যকাল হতেই এতীম ও অসহায় ছিলেন। যখন একটু বড় হলেন তখন চিন্তা করতেছিলেন যে, দু দিনের দুনিয়াতে আরাম করে কোনো লাভ হবে না, তাই চিরস্থায়ী শান্তির খোঁজে তিনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার লক্ষে বলখের গভীর অরণ্যের মাঝে লতাপাতা দ্বারা একখানা ছোট্ট ঝুপড়ি তৈরি করে সেখানে নিরিবিলি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হলেন। সেখানে তিনি কঠোর সাধনা করতেন। বনের ফলমূল ও ঝরনার পানি ছিল সম্বল। প্রায়ই রোযা রাখতেন আর প্রতি শুক্রবারে জংগল থেকে কিছু শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে যে অর্থ পেতেন তার অর্ধেক পয়সা গরীব মিসকিনদের দান করে বাকি পয়সা দ্বারা কিছু রুটি ও খেজুর ক্রয় করে নিকটবর্তী কোনো মসজিদে জুমুআর নামায আদায় করে নিজ আস্তানায় ফিরে আসতেন। সপ্তাহের অবশিষ্ট দিনগুলোতে কঠোর সাধনা ও মুরাকাবা মুজাহাদায় মগ্ন থাকতেন। খাবার ফুরিয়ে গেলে জংগলের ফলমূল সংগ্রহ করে জীবরধারণ করতেন। সাধারণ মানুষের সাথে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। পশমের তৈরি চটের মত মোটা কাপড় দ্বারা জুব্বা সেলাই করে ছতর ঢাকতেন।একবার জুমুআর নামায আদায় করার জন্য শহরের কোনো এক মসজিদে গমন করলেন। সেখানে নামায পড়ার জন্য প্রথম কাতারে দাঁড়ালেন ।ছেঁড়া ফাটা ময়লা পোশাক দেখে লোকেরা সেখান থেকে সরিয়ে দিল। এবার তিনি দ্বিতীয় কাতারে দাঁড়ালেন। সেখান হতেও সরিয়ে দিল। তারপর তৃতীয় এবং চতুর্থ কাতার হতেও অনুরূপভাবে সরিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বশেষ কাতারে গিয়ে জুমুআর নামায আদায় করলেন। কবি বলেন:
আগুনের লেলিহানে লোহা দামি হয়
সাধনার পরশে মানুষ ওলী বনে যায়
নিঃস্ব দরবেশ আদহাম এভাবে কঠোর সাধনা করে একজন মস্তবড় আল্লাহর ওলী হয়ে গেলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁর ছেঁড়া ফাঁটা ময়লা চটের পোশাক ও চুল দাঁড়ী এলোমেলো দেখে পাগল মনে করত। সত্যই তিনি তো আল্লাহকে পাওয়ার জন্য মজনুর মত পাগলই ছিলেন। তিনি সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করেছেন, কিন্তু তাঁর চাল চলন দেখলে মনে হত একজন বয়স্ক মানুষ। তিনি একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই সংসার ত্যাগ করে নিরিবিলী আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ছিলেন এবং মারেফাত অর্জনের লক্ষে নিরিবিলী জংগলকে বেছে নিয়েছিলেন। যাতে তিনি নির্বিঘ্নে কঠোর সাধনা করতে পারেন।
এ দিকে বনের পশু পাখিদের সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তারা যেন তাঁর নিকটাত্নীয়। হরিণগুলো জিহ্বা দ্বারা চেটে চেটে পরিষ্কার করে দিত। পাখিরা তাদের নখ ও ঠোঁট দ্বারা চুল দাঁড়ী আঁচড়ে দিত। হিংস্র পশুরা তাঁর আস্তানা পাহাড়া দিত। কোনো কোনো সময় বন্য গাভী ও বকরী এসে দুধ দেয়ার জন্য বিরক্ত করত। সে অরণ্যে তাঁর কোনো শত্রু ছিল না্ সকলেই তাঁর বন্ধু ও আপনজন, সবাই তাঁর সহযোহিতার জন্য ব্যস্ত থাকত। তিনি যেন সে অরণ্যে একজন মুকুট বিহীন রাজা।
প্রভুর আদেশ তুমি মানিবে যখন,
বাঘ সিংহ অজগর হইবে আপন।
এমনি ভাবে দরবেশ আদহাম কঠোর সাধনা করতে করতে একজন মস্তবড় আল্লাহর ওলী হয়ে গেলেন। কিন্তু কামালাতের পূর্ণতা অর্জন করতে তার কিছু কাজ বাকি ছিল, তা হল নবীর সুন্নাত অর্থাৎ বিবাহ করা। নবীপাক (সা.) ইরশাদ করেন: ”বিবাহ করা আমার সুন্নাত হতে এড়িয়ে চলবে সে আমার উম্মত নয়,” কিন্তু আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা দরবেশ আদহাম সে কথাটি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তার বন্ধুকে সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য হযরত (আঃ) কে নির্দেশ দিলেন যাও আমার পাগল (বন্ধু) কে সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দাও।
দরবেশের প্রতি স্বপ্নাদেশ
দরবেশ আদহাম আল্লাহর মা’রেফাত অর্জনের জন্য জংগলের মধ্যে কঠোর সাধনা করছিলেন। আরাম আয়েশ ভোগ বিলাস সবকিছু বর্জন করেছিলেন। এমনকি রাতের ঘুমকেও হারাম করেছিলেন। একদিন কিছুটা ক্লান্তিবোধ করে একটু তন্দ্রাভিভুত হলেন। এমতাবস্থায় তিনি স্বপ্নে দেখলেন- তার আস্তানার সামনে একজন আগন্তুক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘকায় সাদা পোশাকধারি বিদ্যুতের মত উজ্জ্বল চহারা বিশিষ্ট। তিনি তাঁকে সম্বোধন করে বললেন। হে সাধক! তোমার নাম অন্যান্যদের সাথে ওলীদের দফতরে লেখা হয়েছে, অতেএব তোমাকে তাঁদের সমমর্যাদা অর্জন করতে হলে, তোমাকে এই মুহূর্তে বিবাহ করে ও সংসারজীবন পালন করে কামালাতের পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। যেহেতু জনাব রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘বিবাহ করা আমার সুন্নাত যে তা এড়িয়ে যাবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ যেহেতু বিবাহিত জীবনকে আল্লাহ তাআলা অধিক পছন্দ করেন। তারপর তিনি বলেন,হে আল্লাহর দোস্ত! এসব কথা আমি নিজের পক্ষ থেকে বলছি না: বরং আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা,) এর পক্ষ থেকে বলছি। অতএব এসো তোমার বিবাহের ব্যবস্থাকরে দেই। এসব কথা শুনে তিনি চমকে উঠলেন এবং তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেলো তিনি চিন্তা করতে লাগলেন। কে এই ব্যক্তি ? কথাগুলোতো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তিনি কোথায় বিবাহ করবেন, কে দেবে তাকে মেয়ে? তিনি তো একজন জংগলবাসী ফকীর । থাকা খাওয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। যখন জোটে তখন খান আর যখন কিছু না পাওয়া যায় তখন রোযা রাখেন। ঘরবাড়ি আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। ছেঁড়া ফাটা পোশাক পরে ছতর ঢাকতে হয়। এমতাবস্থায় তার দ্বারা একাজ মোটেই সম্ভবপর নয়। এরপর তিনি উযূ করে ইবাদতে মশগুল হলেন্। পরবর্তী রজনীতে সে ব্যক্তি পুনারায় স্বপ্নযোগে বললেন, হে দরবেশ! তোমার কোনো ভয় নাই। তুমি শুধু এরাদা কর, আল্লাহপাক তোমার এরাদা অবশ্যই পূর্ণ করবেন। তিনি তোমার প্রতি সদয় আছেন। হে সাধক! তুমি আমার কথাগুলো বিশ্বাস কর। আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য একজন সতী ও সুন্দরী নাজকন্যাকে তোমার স্ত্রী রূপে নি র্ধারণ করে রেখেছেন। তবে তোমাকে কিছু কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। তুমি তাতে ধৈর্যহারা হবে না। যেহেতু আল্লাহ তাআলা র্ধৈযশীলদের পছন্দ করেন। তুমি সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে তার সাহায্য কামনা করতে থাক। তিনি সকল সমস্যার সমাধানকারী ।আমি তোমাকে আরো একটা শুভসংবাদ শুনাচ্ছি। তা হল তোমাদের ঘরে আরেকজন যুগশ্রেষ্ঠ ওলীর আগমন হবে। এ সময় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি চেয়েছিলেন আগন্তুকের কাছে আরো কিছু কথা জিজ্ঞেস করবেন, কিন্ত তা সম্ভব হল না। Read More...




0 Reviews